সব

গল্প কথায় ইউ‌রো‌পের ই‌তিহাস: কি‌স্তি ৮

গল্প কথায় ইউ‌রো‌পের ই‌তিহাস: কি‌স্তি ৮

হিটলার, স্ট্যালিন এবং বিধ্বস্ত পোল্যান্ড

ড. মো. আ‌নোয়ারুল ইসলাম

অ‌নেক‌দিন ধ‌রে গ‌ল্পের আসর নেই। ক্লাস পরীক্ষা নি‌য়ে সক‌লেই ব‌্যস্ত। পুজার ছু‌টি‌তে সবাই দাদা বাড়ী চ‌লে এ‌সে‌ছে। মন্ডল সা‌‌হেবও খুব খু‌শি। ও‌দের‌কে ইউ‌রো‌পের ই‌তিহা‌সের বাকী গল্পগু‌লো ‌শোনা‌নো যা‌বে।
মন্ডল সা‌হেব জি‌নিয়া‌কে জি‌জ্ঞেস কর‌লেন দাদুভাই তোমার ব্রেকফাস্ট হ‌য়ে গে‌ছে। তাহ‌লে সকল‌কে ডা‌কো। চ‌লো আমরা আবারও গল্প শুরু ক‌রি।

‌জি‌নিয়া বল‌লো দাদু ভাই সবাই এ‌সে গে‌ছে। রি‌ডিংরু‌মে ব‌সে আ‌ছে। চল আ‌মি আর তু‌মি গে‌লেই হ‌বে।
ও আচ্ছা তাই। তাহ‌লে চ‌লো। ব‌লেই রি‌‌ডিংরু‌মে গি‌য়ে সোফায় ব‌সে গল্প শুরু কর‌লেন।
মন্ডল সা‌হেব বল‌লেন ব‌লো দে‌খি নাশতায় কে কি খে‌য়ে‌ছো। সক‌লের বলা শেষ হ‌লে জি‌নিয়া বল‌লো আ‌মি স‌্যান্ডউইচ খে‌য়ে‌ছি।
মন্ডল সা‌হেব বল‌লেন তাহ‌লে স‌্যান্ডউই‌চের গল্প দি‌য়েই শুরু ক‌রি। দ্বিতীয় বিশ্বযু‌দ্ধের সময় পোল‌্যা‌ন্ডের অবস্থা দাড়া‌লো স‌্যান্ড উই‌চের ম‌তো। কি করুণ দশা! একেবারে বিধ্বস্ত। পশ্চিমে হিটলার এবং পূর্বে স্ট্যালিন।

চা‌রি‌দি‌কে শুধু ধ্বংস, আর মৃত্যু। পোল‌্যা‌ন্ডের দুই দিক থে‌কে জার্মানী এবং ‌সো‌ভি‌য়েত বা‌হিনী মি‌লে আক্রমণ শুরু কর‌লেন। পোল‌্যা‌ন্ড সহ সমগ্র ইউ‌রোপ ভ‌্যাবাচাকা খে‌য়ে গেল।

‌সো‌ভি‌য়েত বা‌হিনী জার্মান‌দের স‌ঙ্গে যোগ দিল কিভা‌বে? না‌হিদ উ‌ত্তে‌জিত হ‌য়ে প্রশ্ন কর‌লো।

‌কেন তোমা‌দের ম‌নে নেই গতবা‌রে আমরা গল্পটা শেষ ক‌রে‌ছিলাম ডান‌জিগ বন্দর দখল করা‌কে নি‌য়ে। ‌হিটলার 1939 সা‌লের আগস্ট মা‌সে রুশ জার্মান অনাক্রমণ চু‌ক্তি ক‌রে‌ছিল। এ‌তে ক‌রে হিটলা‌রের সাহস বে‌ড়ে যায়।

কিন্তু পোল‌্যান্ড আক্রম‌ণের শুরুটা কিভা‌বে এবং জার্মান সো‌ভি‌য়েত কিভা‌বে আক্রমণ শুরু কর‌লো সেই ঘটনাটা শুন‌তে চাই। জে‌নিফা বল‌লো।

ও আচ্ছা তাহ‌লে শো‌নো ব‌লেই মন্ডল সা‌হেব বল‌তে লাগ‌লেন‌ ‌হিটলার পোল‌্যান্ড দখল করার জন‌্য রাইকস্টা‌গের সভা আহবান কর‌লেন। সেখা‌নে বল‌লেন পো‌লিশ সৈন‌্যরা জার্মান সৈন‌্যদের উপর চোরাগুপ্তা হামলা চালা‌চ্ছে। সুতরাং এর উপযুক্ত জবাব দি‌তে হ‌বে। আস‌লে কি জা‌নো
হিটলারের ঐ নির্জলা মিথ্যে দিয়েই যুদ্ধের শুরু৷ কারণ সেসব সেনা ছিল হিটলারের বিশেষ এস এস বাহিনীর সদস্য৷ পোলিশ সেনাদের পোশাক পরে হিটলারের গোপন বাহিনী অভিনয় শুরু করে।
এই অভিযোগ নিয়েই হিটলার আক্রমণ শুরু হ‌লো 1939 সা‌লের 1 সে‌প্টেম্বর । তবে আক্রম‌ণের ‌দিনক্ষণ হিটলার বহু আ‌গে থে‌কেই ঠিক ক‌রে রে‌খে‌ছিল। রাইকস্টাগে হিটলার বলেছিল,This night for the first time Polish regular soldiers fired on our own territory. We have now been returning the fire since 5:45 a.m.! (Seit 5.45 Uhr wird jetzt zuruckgeschossen!) Henceforth, bomb will be met with bomb.
(পোল্যান্ড আজ রাতে প্রথম আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করেছে, আমাদের সেনাদের ওপর গুলি চালিয়েছে৷ ভোর পৌনে ছ’টা থেকে পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়েছে৷ এবং এখন থেকে বোমার জবাব দেবে পাল্টা বোমা৷)

তাই না‌কি? হাল্কা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়‌লো না‌হিদ।

মন্ডল সা‌হেব বল‌লেন, 1939 সা‌লের 1 সে‌প্টেম্বর, রাত নয়টা। পৃ‌থিবী নিঝুম- নিথর। মেঘমুক্ত চন্দ্রা‌লো‌কিত আকাশ। সমস্ত রাত ধ‌রে শত শত ট‌্যাঙ্ক, দূরপাল্লার কামানসহ সাম‌রিক কনভয়, সৈন‌্য বোঝাই ল‌রি, ডি‌ভিস‌নের পর ডি‌ভিসন নাৎসী বা‌হিনী ঝ‌ড়ের গ‌তি‌তে ঝুট‌ছে পোল‌্যা‌ন্ডের দি‌কে। ও‌দের নি‌র্দেশদাতা স্বয়ং হিটলার। বল‌তে লাগ‌লো ” পোল‌্যান্ড আক্রমণ ক‌রো। নাস্তানাবুদ ক‌রো শত্রুপক্ষ‌কে। য‌তো তাড়াতা‌ড়ি পা‌রো অ‌ধিকার ক‌রে নাও পোল‌্যান্ড। ফ্রান্স আর ব্রিটেন পোল‌্যান্ড‌কে সাহায‌্য করার আ‌গেই শেষ ক‌রে ফে‌লো যুদ্ধ। সারা দু‌নিয়া‌কে জা‌নি‌য়ে দাও জার্মানীর ‌শৌর্য বীর্য। ভয় পাবার কো‌নো কারণ নেই।”

তাহ‌লে যুদ্ধ শুরু হ‌য়ে গেল। জে‌নিফা বল‌তে লাগ‌লো।

হ‌্যাঁ। চারি‌দি‌কে মহা ধ্বংস যজ্ঞ শুরু হ‌য়ে গেল। পোল‌্যা‌ন্ডের আকাশ অন্ধকার ক‌রে ঝা‌ঁকে ঝা‌ঁকে জার্মানীর বিমান বা‌হিনী উড়‌তে লাগ‌লো । পোল শহ‌রে বোমার পর বোমা পড়‌ছে। অ‌বিশ্রান্ত বোমা বর্ষণ চল‌ছে। উচ্চ অট্টা‌লিকা, সরকারী ইমারত, বেসরকারী দালান কোঠা, দোকান পাট ধ্বংস হ‌তে লাগ‌লো। আগুন জ্ব‌লে উঠ‌ছে পোল‌্যা‌ন্ডের এখা‌নে ওখা‌নে।

এটা ঠিক আমাদের দেশের ইতিহাসের মতো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রিতে যেভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের দেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ঠিক সেরকম।
হ্যাঁ তাইতো দেখছি। লিমন এতোক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল।

মন্ডল সাহেব বলতে লাগলেন যেন ‘হঠাৎ করেই শুরু হয় বোমা বর্ষণ, গোলাগুলি, চারিদিকে মৃতদেহ ৷ ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯৷ ভোর প্রায় সাড়ে চারটা৷ জার্মান জঙ্গি বিমানে ছেয়ে যায় পোল্যান্ডের ছোট শহর ভিলুনের আকাশ৷ কেন এই যুদ্ধ তখনো কারো কাছে তা পরিস্কার নয়৷ এই আক্রমণের জন্যও কেউ তৈরি ছিল না৷ ভিলুন ছোট একটি শহর, কোন সেনা নেই, নেই তার কোন সামরিক গুরুত্ব৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছাই আর ধ্বংসস্তূপের শহরে পরিণত হয় ভিলুন৷
আক্রমণের শুরুতেই প্রায় দেড় লক্ষ সশস্ত্র জার্মান সশস্ত্র সেনা দ্রুত এগিয়ে যায় পোল্যান্ডের সীমান্তে৷ হিটলারের মিথ্যাচারের মূল্য পোলিশদের দিতে হয় জীবন দিয়ে৷
দ্রুত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ভূখন্ড দখলই শুধু নয়, পোলিশ জাতিকে ধ্বংস করাও হিটলারের অন্যতম মূল লক্ষ্য৷ এরপরই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ৷ পোল্যান্ডের শিক্ষিত এবং সুশীল সমাজকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ৷ অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনবিদ, লেখক, রাজনীতিকদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়৷ চালানো হয় নির্বিচার ইহুদী নিধন৷
পাঁচ বছর ধরে পোল্যান্ড গণহত্যার শিকার হয়৷ প্রাণ হারায় প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ৷ এর মধ্যে ছিল তিন লক্ষ পোলিশ ইহুদী৷ পোল্যান্ড আক্রমণ হিটলারের জন্য ছিল আরো বড় এক যুদ্ধেরই মহড়া৷ বিশ্বযুদ্ধ আদতে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এরপরই৷
পোল্যান্ড কি এর কোন প্রতিবাদ করেনি? কিংবা ফ্রান্স, বৃটেন, আমেরিকা এদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল লিমন জিজ্ঞেস করে।
বাহ লিমন খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছো। আমি সেসবই এখন বলতে চাইছি। তাহলে মন দিয়ে শোনো।

হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের খবর চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়লো। জার্মানীর ফ্রান্স এবং ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানানো হলো। সমস্ত লন্ডন শহর উত্তপ্ত। কমন্স সভার আহবান করা হলো। পোল্যান্ড আক্রমণের দুইদিন পর ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন এক বেতার ভাষণ দিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিনের বেতার ভাষণের সারমর্ম হলো যুদ্ধ করা ছাড়া ব্রিটেনের সামনে আর কোন পথ খোলা নাই। ব্রিটিশ পত্র পত্রিকায় লেখা হলো- Britain Now at War; “Hitler Would Not Have Peace” ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণের শিরোনাম হলো: Premier: We are ready. অপরদিকে ফ্রান্সও জার্মানীকে পোল্যান্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। কিন্তু কে শোনে কার কথা। হিটলার এগুলো পাত্তা না দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে লাগলো। উপরন্ত ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ হিটলার নিজেই পৌঁছে গেলেন সীমান্তে। সীমান্তের সীমানা ফলক দেখিয়ে তিনি বললেন, “এটা উঠিয়ে ফেলো। আজ থেকে পোল্যান্ডের মাটি হলো আমাদের মাটি।”

বক্তৃতা এবং গরম গরম খবর ছাড়া পোল্যান্ড তাৎক্ষণিকভাবে ব্রিটেন-ফ্রান্সের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পেল না। ফলে পোল্যান্ডের সেনাবাহিনী দুর্ধর্ষ জার্মান সেনাদেরকে ঠেকিয়ে দিচ্ছিলো। ১০ লক্ষ পোলিশ সেনা মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হলো।
হিটলার যেমন ভেবেছিলেন ব্যাপারটা তেমন হলো না।তিনি ভেবেছিলেন, পোল্যান্ড দখল করতে দুই দিনের বেশি লাগার কথা নয়। প্রায় ১৫ দিন কেটে গেলো। পুরো পোল্যান্ড তখনও হাতে আসে নি জার্মানীর। এমন সময়ে বেতারে খবর এলো, ব্রিটিশ সৈন্যদল ফ্রান্স উপকূল ধরে পোল্যান্ডের দিকে ধেয়ে আসছে। যে কোনো সময় পোল্যান্ড সৈন্যদলের সাথে মিশে জার্মান বাহিনীর উপর হামলা করতে পারে।
তারপর কি হলো? সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো।
মন্ডল সাহেব বললেন হিটলার আবার হিটলারী চাল শুরু করলেন। তিনি দেখলেন, পোল্যান্ড দখল করতে দেরী হচ্ছে, আর ব্রিটিশ সৈন্যরাও চলে আসছে তখন জরুরি তারবার্তা পাঠালেন রাশিয়ার একনায়ক স্ট্যালিনকে। স্ট্যালিনকে তিনি বললেন, “আমরা পোল্যান্ডের পশ্চিম প্রাপ্ত দখল করে ফেলেছি। পূর্বপ্রান্ত আপনি দখল করুন।”
এরপর কি হলো? নাহিদ জিজ্ঞেস করলো মন্ডল সাহেবকে।
যা হবার তাই হলো। তোমাদের এর আগে জার্মান এবং রুশ চুক্তির গল্প করেছিলাম। এরা হলো নতুন দোস্তী। এ কারণে হিটলারের আহবানে সাড়া দিলেন স্ট্যালিন। রাশিয়ার অপেক্ষমান সৈন্যবাহিনীকে আদেশ দিলেন পোল্যান্ড সীমানা অতিক্রম করতে। দ্রুতত গতিতে পোল্যান্ডের সমৃদ্ধশালী পুর্বাঞ্চল দখল করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না রাশিয়া।
রাশিয়ান সেনাবাহিনী পালন করলো নেতার আদেশ। পশ্চিম প্রান্তে দুর্ধর্ষ জার্মান সেনা আর পূর্বপ্রান্তে মহাশক্তিধর রাশিয়া। এই দুই দেশের সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে পোল্যান্ড হলো নাস্তানাবুদ ।
১৯৩৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখের বিশ্বের সকল পত্রিকায় খবর বের হলো: Russia Enters War: Invades Poland; Soviet Formally Joins Forces with Nazis; Communist Army Begins Drive into Polish Area; Russians Cross Frontier, Keeping Pledge to Hitler.
তাহলে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন কিছুই করলো না। জিনিয়া জানতে চাইলো।
মন্ডল সাহেব বললেন না তারা কিছুই করতে পারলো না। পোল্যান্ড আক্রমণে হিটলারের সাথে স্ট্যালিনের একাত্মতায় ব্রিটেন এবং ফ্রান্স একদম বোকা বনে গেলো। পোল্যান্ডকে সহায়তা করার আগেই সব শেষ। ব্রিটেন ফিরিয়ে নিলো সৈন্যদল। ফ্রান্স একেবারে নিশ্চুপ। পোল্যান্ড হলো ধ্বংসস্তূপ।
এই ধ্বংসস্তূপের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না।

পাঁচ বছর ধরে পোলিশদের ওপর চললো হিটলারের নাৎসীবাহিনীর অকল্পনীয় অমানুষিক অত্যাচার। পোলিশ নাগরিকদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছিল সে সমস্ত বীভৎস অত্যাচার কাহিনী অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল।
হিটলারের ইহুদী নিধনের জন্য পোল্যান্ড ছিল বধ্যভূমি। তোমরা তো জানো হিটলার ছিল ইহুদী বিরোধী। ইউরোপ থেকে স্লাভ এবং ইহুদীদের নির্মূল করার জন্য হিটলার ও তাঁর নাৎসী নেতারা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। বন্দী শিবির ছিল অন্যতম।
আউসভিৎস, বার্কেনাউ, মাজডানেক, স্টাটহফ এবং গ্রস রোজেন বন্দী শিবির ছিল প্রধান। বন্দী শিবিরগুলোতো ইহুদীদের মেরে ফেলা হতো। তোমরা এখন ইউটিউবে অনেক ডকুমেন্টারি দেখবে যেখানে এই গণহত্যার ভয়াবহতা দেখতে পাবে। ঠিক এই রকমই একটি ডকুমেন্টারি নাইট এ্যান্ড ফগ ।
১৯৫৫ সালে প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার অ্যালা রেঁনে’র এটি নির্মাণ করেন। নাইট এ্যান্ড ফগ প্রামাণ্যচিত্রের পটভূমি নাৎসি কনসেনট্রেশান ক্যাম্প – পোল্যান্ডের অশউইৎজ এবং মাইদানেক বন্দিশিবির। এটি নাৎসিদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ওপর নির্মিত একদম শুরুর দিককার চলচ্চিত্রিক দলিল।
এর মূল বিষয়বস্তু কী? একটু বললেই তো আমরা বুঝে যাব। জিনিয়ার এই কথা শুনে সবাই ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিল।
মন্ডল সাহেব বললেন, নাৎসিদের যারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবেন, তাদের সাজা হবে ভয়াবহ। শিবিরে নিয়ে রাতের আঁধারে কুয়াশায় তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। ১৯৪১ সালের শেষভাগে নাৎসি পার্টির হাইনরিখ হিমলার গৃহীত এ কৌশলটি থেকেই ডকুমেন্টারিটির নাম ‘নাইট অ্যান্ড ফগ’। তোমাদের আরেকটি ডকুমেন্টারির কথা বলি।

১৯৮৫ সালে নির্মিত শোয়াহ একটি অন্যতম ডকুমেন্টারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি পার্টি কর্তৃক ইহুদি নিধনযজ্ঞ যা হলোকাস্ট কিংবা হিব্রু ভাষায় ‘শোয়াহ’ বলে অভিহিত, তা-ই সাড়ে নয় ঘণ্টার এই ডকুমেন্টারির মুখ্য বিষয়।
হিটলারের ইহুদী বিরোধী মনোভাব কেন হয়েছিল? নাহিদ জিজ্ঞেস করে।
মন্ডল সাহেব বলেন এটা আসলে একটা কঠিন প্রশ্ন। এর পেছনে আসলে জার্মান জাতীয়তাবাদকে তীব্রতর করাই ছিল মূল কারণ। হিটলার এবং নাৎসিরা মনে করতো জার্মানরা আর্যজাতির বংশধর এবং শ্রেষ্ঠ জাতি। এই তত্ত্বই তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ায়। নাৎসিরা জার্মান শিশুদের ইহুদি বিদ্বেষী শিক্ষা দেয়া শুরু করে। হিটলার ইহুদী জাতির বিরুদ্ধে ১৯২৪ সাল থেকে বিদ্বেষমূলক প্রচার শুরু করেন Volkischer Beobachter পত্রিকায়। আবার কোনো কোনো নাৎসী নেতা খুব ঘৃণ্য ভাষায় ইহুদীদের সমালোচনা করতো। তাঁরা মনে করতেন এদের সুসভ্য ইউরোপে বেঁচে থাকার অধিকার নাই। হিটলার ঘোষণা করলেন সমগ্র ইউরোপ থেকে ইহুদী নির্মূল করতে হবে । ইহুদী বন্দীদের ধরে এনে পোল্যান্ডের বন্দী শিবিরগুলোতে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হতো। বন্দী শিবিরগুলোকে ডেথক্যাম্প বলা হতো। বন্দীশিবিরগুলো ছিল বিভীষিকাপূর্ণ মৃত্যুপুরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের বন্দী শিবিরগুলোতে হত্যা করা হয়েছিল।
আমরা পোল্যান্ডের কথায় ফিরে আসি। শুধু জার্মানিই নয় সোভিয়েত রাশিয়াও ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল পোল্যান্ডে।
লিমন বললো সোভিয়েত রাশিয়াও পোল্যান্ডে নৃশংসতা চালিয়েছে।
হ্যাঁ বলেই মন্ডল সাহেব বললেন
পোল্যান্ড সহ্য করেছে রাশিয়া আর জার্মানীর নৃশংসতা। পোল্যান্ড দেশটাকে চুরমার করে দিয়েছে এই দুই শক্তির দেশ। রাশিয়ানরা যেটা করেছে সেটা আরও ভয়ংকর। পোল্যান্ডের লাখ খানেক সৈন্য রাশিয়ানদের হাতে বন্দী হয়। পোল্যান্ড যাতে কোনোদিন প্রতিরোধ যুদ্ধ না চালাতে পারে সেজন্য চৌকষ সামরিক অফিসারদের একজন একজন করে ধরে হত্যা করা হয় রাশিয়ার খোলেনন্স্ক শহরের কাটিন বনে। প্রায় ২২ হাজার পোল্যান্ডের নাগরিককে হত্যা করে রাশিয়ানরা; যার মধ্যে ১৫ হাজার ছিলো সামরিক বাহিনীর লোক। পোল্যান্ডের প্রায় সব সামরিক অফিসারদের হত্যা করেছিলো রাশিয়া। এই বন পোলিশ জনগণের কাছে আজও অভিশপ্ত বন নামে পরিচিত। শুধু কি সামরি শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তারসহ মেধাবী লোকজনদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে রাশিয়ানরা। তোমাদের একটা সিনেমার কথা বলি যেটা দেখলেই তোমরা বুঝতে পারবে পোল্যান্ডকে কত রক্ত দিতে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী জানতে হলে সিনেমাটি দারুণ কাজে লাগবে। সিনেমার নাম ‘Katyn.’ পোল্যান্ডে নির্মিত এই সিনেমাটি ২০০৭ সালে মুক্তি পায়।
এই সিনেমায় দেখবে অসহায় গর্ভবর্তী নারীর আর্তনাদ। ভয়ার্ত নয়নে পেটে হাত রেখে সেই গর্ভবতী নারী দৌড়াচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু কোথায় পাবেন তিনি সেই আশ্রয়? প্রসব বেদনায় কাতর কোনো মহিলা সন্তান প্রসব করার মুহুর্তে অন্য সব চিন্তা বাদ দিয়ে কেবলই ভাবছেন, অনাগত সন্তানকে নিয়ে কি তিনি একটু সময়ের জন্য হলেও মাটিতে শুতে পারবেন?
সিনেমার দৃশ্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পোল্যান্ডের মেধাবী সামরিক অফিসারদের মুরগীর বাচ্চার মতো ধরে বেঁধে পাইকারী হারে হত্যা করে মাটিচাপা দিচ্ছে একদল রক্তপিপাসুর দল। বাজারে মুরগি জবাই করার পরে একটু পর পর পানি দিয়ে রক্ত মুছে ফেলে মুরগি ব্যবসায়ী; যাতে সারাদিন ধরে মুরগি জবাই করা যায়। কতটা ব্রুটালিটি! সিনেমাতেই যদি এতোটা ভয়ঙ্কর হয় তাহলে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর অক্টোবরে কি ঘটেছিল। গাঁ শিউরে উঠার মতো ঘটনা।
আজকের গল্প শেষ করবো নোবেলজয়ী পোলিশ কবি মিউশ এর কথা বলে। কবি মিউশ তিনিও হিটলারের বাহিনীর কাছে এক অস্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্পে আটক ছিলেন। কিন্তু তাঁর এক আত্মীয়া জার্মানদের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। নাৎসীদের এই ঘটনা তিনি তুলে ধরেছেন দ্য ক্যাপটিভ মাউন্ড গ্রন্থে ১৯৪৫ সালে। যেখানে কবি মিউশ লিখলেন চমৎকার সেই অভিব্যক্তি-
তুমি মিশিয়ে ফেলেছিলে ঘৃণার অনুপ্রেরণার সঙ্গে গীতল সৌন্দর্য.
অন্ধ পশু শক্তির সঙ্গে সুসম্পাদিত আকার।
কাকে বলে কবিতা, যদি তা না – বাাঁচায়
দেশ কিংবা মানুষকে?…

এরপর মন্ডল সাহেব বললেন তাহলে আজ এ পর্যন্তই। আগামী কোনো একদিন পোল্যান্ডের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলবো ।

আপনার মতামত লিখুন :

তুই মানে – ইমি

তুই মানে – ইমি

গল্প কথায় ইউ‌রো‌পের ই‌তিহাস: কি‌স্তি ১১

গল্প কথায় ইউ‌রো‌পের ই‌তিহাস: কি‌স্তি ১১

গল্প কথায় ইউ‌রো‌পের ই‌তিহাস: কি‌স্তি ৮

গল্প কথায় ইউ‌রো‌পের ই‌তিহাস: কি‌স্তি ৮

হেমন্তের হাতছানি ! 

হেমন্তের হাতছানি ! 

“শিশুদের সুপ্ত বিকাশ হোক বাঁধাহীন”

“শিশুদের সুপ্ত বিকাশ হোক বাঁধাহীন”

অনন্যা – আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী

অনন্যা – আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: PabnaTimes24.Com

সম্পাদক: মোঃ মুস্তাফিজুর রহমান
০১৭২১৭৪৭৯৬৫
অফিসঃ ৪র্থ তলা, রানা শপিং কমপ্লেক্স , পাবনা প্রেস ক্লাব গলি, আব্দুল হামিদ রোড, পাবনা-৬৬০০
pabnatimes24.com@gmail.com